ওয়েব নিউজ, ২ মে: বাংলা সিনেমার জগৎ এগিয়েছে অনেক দূর, নতুন পরিচালক নতুন পরিকল্পনা নতুন ঘটনা নিয়ে। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এত নতুনত্বের আগমন ঘটার পরও বাংলা সিনেমা জগতের মহারাজার আসন যেন আজও খালি। সত্যজিৎ রায়ের রেখে যাওয়া জায়গাটা যেন কোথাও গিয়ে ফাঁকাই পরে রয়েছে।
সত্তরের দশকে থেকেও দলীয় রাজনৈতিক মহলের বাইরে থেকেও যে স্পষ্টতর ভাবে রাজনৈতিক চিত্র তাঁর চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন তেমন চিন্তাধারার বর্ষণ এখন কোথায় !!!
বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পুরোটাই হয়ে উঠেছে রাজনীতি নির্ভর; কিন্তু সেখানে তৈলমর্দন ছাড়া যেন আর কিছুই নজরে আসে না। সত্যজিৎ রায় নিজের শিরদাঁড়াকে সোজা রেখে সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার যোগ্যতা রাখতেন। তেমন মেরুদন্ড যেন আজ কোথাও হারিয়ে গেছে।
বাংলা সিনেমার নবজগতে পদার্পণ হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২৬ শে আগস্ট। আর সেই জগতে পদার্পণের দূত জন্মদিন হল আজ, ২রা মে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতেও আমরা তাঁকে উপহার দিতে পারি নি তাঁর চিত্রভাবনাকে ফুটিয়ে তোলার মত আর এক মহারাজকে।
বিভূতিভূষণ রচিত ‘ পথের পাঁচালী’ র হাত ধরেই নিজের জমির ভিতপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। তাঁর পরিচালিত ‘ পথের পাঁচালী’ শুধু বাঙালিদের মাঝে নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি ক্ল্যাসিক মুভি হয়ে গেছে। এই সিনেমা দিয়েই তিনি বাংলা সিনেমার প্রকৃতি চরিত্রর আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের শেষ ছবি ‘ আগন্তুক ‘ তিনি বানিয়েছিলেন চরম শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে। এই ছবিতে তিনি খুলে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক জীবন দর্শন, তার সাথে শিক্ষার গর্বে গর্বিত বাঙালির চোখের পর্দাও তুলে ফেলার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর এই শেষ সৃষ্টি দেখে মনে হয় যেন বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রাপ্তমনষ্ক করে তোলার গুরুভার তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন।
‘পথের পাঁচালী’ -তে যেমন গ্রাম্য পরিবেশকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের ক্যামেরায়, সেরকমই কলকাতা শহর নিয়ে তৈরি ‘মহানগর’ চলচ্চিত্রে তিনি নিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন শহুরে জীবনের উপকথা ; স্বপ্ন ও আশাভঙ্গের এক সুন্দর মেলবন্ধন।শহুরে জীবন নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ‘প্রতিদ্বন্দী’ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ‘সীমাবদ্ধ’ নামে ট্রিলজি। নকশাল আন্দোলন, বেকারত্বের জ্বালা, শিক্ষিত যুবসমাজের দিশেহারা অবস্থা নিয়ে চিত্রপটে এঁকেছেন শহুরে জীবনের ছবি।
সামাজিক ছবিই শুধু নয়, তাঁর হাত দিয়ে উঠে এসেছে ‘ফেলুদা’ বা ‘প্রফেসর শঙ্কু’ সিরিজ। তাঁর তৈরি ‘ গুপি গাইন বাঘা বাইন ‘ সিরিজও বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।
শুধু মাত্র ক্যামেরাবন্দি করাই নয়, প্রতিটা ছবিতে তাঁর সুরও মাধুর্য দান করে তাঁর সৃষ্টিকে যেন আরো কয়েকশ যোজন উপরে নিয়ে গেছে। গুপী- বাঘা সিরিজের গান থেকে শুরু করে ফেলুদার সেই রহস্যজনক সুর চলচ্চিত্র গুলোকে যেন সম্পূর্ণতা দান করে।
বাংলা সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই নিজের গুণের ছাপ সর্বত্র দিয়ে রেখেছেন। খুদে পাঠকদের কাছে তিনি এখনও প্রিয় লেখক। নিজের ক্যালিগ্রাফির প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে তৈরি করে ফেলেছিলেন ‘ রে ফন্ট ‘।
এমন একজন সর্বতোগুণী মানুষকে বিনম্র শ্রদ্ধা আমরা আর কি করতে পারি। প্রায় পাঁচ দশকেও আমরা তাঁর উত্তরসূরী তৈরি করতে পারি নি, তাঁর রেখে যাওয়া ফাঁকা জায়গা আমরা কোনোদিন ভরতে পারবো কিনা তাও হয়তো জানি না।